বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০০ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, বিবাহিত জীবনে বিচ্ছেদের অন্যতম কারণসমূহের মধ্যে রয়েছে যৌতুক, পরকীয়া, নির্যাতন ও আকাশ সংস্কৃতি। তবে একটি জরিপ সংস্থা প্রকাশ করছে, বিদেশে অবস্থানরত অনেক পুরুষ তাদের স্ত্রীকে দীর্ঘদিন দেশে রেখে যাওয়ায় স্ত্রীরা জৈবিক খোরাক নিবারণের জন্য পুরুষ বন্ধু বেছে নিচ্ছে। তথ্য বলছে, শতকরা ৪৩ ভাগ বিবাহিত নারী পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন। তার অন্যতম কারণ স্বামীর চাকরি, ব্যবসা বা অন্য কাজে গড়ে বছরের ১০ থেকে ১১ মাস ঘরের বাইরে থাকা। ফলে বিদেশে বসেই অনেক পুরুষ তার দেশে থাকা স্ত্রীকে তালাক দিতে চায়। এ ক্ষেত্রে বাঁধে নানা বিপত্তি। এখন জেনে নেয়া যাক বিদেশ থেকে কিভাবে স্ত্রীকে তালাক প্রদান করা যায়।
বিদেশ থেকে স্ত্রীকে তালাক প্রদান করতে হলে দেশে কোন নিকটাত্মীয় কিংবা বিশ্বস্থ কাউকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। এ তালাক প্রদানের ক্ষমতা হচ্ছে পাওয়ার অব এ্যাটর্নী বা আমমোক্তারনামা। এটি হচ্ছে একটি আইনগত দলিল। ষ্ট্যাম্প এ্যাক্ট ১৮৯৯ এর ২(২১) উপ ধারা অনুসারে যে দলিল দিয়ে কোনো ব্যক্তিকে অপর কোনো ব্যক্তির পক্ষে হাজির হয়ে যে সকল কার্যাবলী সম্পাদন করার ক্ষমতা দেয়া হয় তাকে আমমোক্তারনামা দলিল বলে। এ ক্ষেত্রে যাকে আমমোক্তার নিয়োগ করা হলো তিনি আপনার পক্ষে আপনার স্ত্রীকে তালাক প্রদানের যাবতীয় কার্যাবলী সম্পাদন করবেন। তবে আমমোক্তারনামা দলিলে স্পষ্ট করে লেখা থাকতে হবে যাকে পাওয়ার বা ক্ষমতা দেওয়া হলো তিনি শুধু তালাক কার্যাবলী সম্পাদন করতেন পারবেন। এবার আপনার করণীয়সমূহ নি¤œরুপঃ
প্রথমতঃ দেশে অবস্থিত কোন আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করূন
দ্বিতীয়তঃ আইনজীবীর মাধ্যমে তালাকের নোটিশটি প্রস্তত করূন
তৃতীয়তঃ আইনজীবীর মাধ্যমে একটি আমমোক্তারনামা প্রস্তুত করুন
চতুর্থতঃ আমমোক্তার নামাটি এবং তালাকের নোটিশটি আপনার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন
পঞ্চমতঃ আমমোক্তার নামাটি যখন আপনার কাছে পৌঁছাবে আপনি সেখানে স্বাক্ষর করবেন এবং তালাকের নোটিশেও আপনি স্বাক্ষর করবেন। তবে এ কাজটি করতে হবে বিদেশী নোটারী পাবলিক, আদালতের বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেট বা বাংলাদেশ দুতাবাসের বাণিজ্যদুত বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধির সম্মুখে। এবং তার দ্বারা মোক্তারনামাটি প্রত্যায়ন করে পাঠাতে হবে এবং নিজ দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তা সত্যায়িত করাতে হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের কার্যালয় থেকে স্ট্যাম্পযুক্ত হতে হবে।
সহজ করে বলতে গেলে মোক্তারনামা বিদেশ থেকে মুসাবিদা করে দেশে পাঠানো যায় আবার দেশে কোনো আইনজীবী দিয়েও ইংরেজিতে মুসাবিদা করিয়ে বিদেশে আমমোক্তারদাতার কাছে পাঠানো যায়। তবে দেশ থেকে ড্রাফটিং করে বিদেশে পাঠানো ভালো। দ্বিতীয়ত, যে দেশে ফরেন পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদিত হবে সে দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের কনস্যুলারের সামনে দাতা স্বাক্ষর করবেন এবং কনস্যুলার কর্তৃক তা সত্যায়িত হওয়ার পর আমমোক্তারদাতা তার ক্ষমতা আমমোক্তার গ্রহীতা বা অ্যাটর্নির বরাবরে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবেন। তৃতীয়ত, আমমোক্তার সাহেব ওই পাওয়ার অব অ্যাটর্নি পাওয়ার পর তা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সহকারী সচিব বা কনস্যুলার থেকে সত্যায়িত করে নেবেন।
ষষ্ঠতঃ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমমোক্তারনামাটি সত্যায়িত হওয়ার পর তা জেলা প্রশাসকের রাজস্ব কার্যালয়ে জমা দিয়ে ২০০ টাকার স্ট্যাম্প লাগাতে হবে এবং সেখানে আমমোক্তারনামা দলিলের ওপর একটি নাম্বার ও তারিখ পড়বে। এরকম বিদেশি আমমোক্তারনামার সঠিকতা যাচাই করতে হলে জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কার্যালয়ে গিয়ে ওই নাম্বার দিয়ে যাচাই করে নেয়া যায়।
এরপর আমমোক্তারদাতা ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের ৭(১) ধারার বিধান অনুযায়ী বিদেশে অবস্থানরত স্বামীর পক্ষে স্ত্রী যে এলাকায় বসবাস করছেন সে এলাকার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান/পৌর মেয়র/সিটি কর্পোরেশন মেয়রকে ওই তালাকের নোটিশ রাষ্ট্রীয় ডাকযোগে এডি সহযোগে প্রেরণ করবেন। সেই সাথে তালাক গ্রহীতাকে উক্ত নোটিশের নকল প্রদান করতে হবে। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তালাকের নোটিশটি কত সময়ের মধ্যে পাঠাতে হবে। আইনে বলা আছে তখনই/ পরবর্তী সময়ে/ যথাশীঘ্রই সম্ভব। এরপর আপনার তালাকের মেয়াদ শুরু হয়ে যাবে। তার ৯০ দিন পর আপনার তালাকটি কার্যকর হবে।
তবে নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই যদি তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী অন্য কারও সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে উক্ত বিয়ে অবৈধ বলে গণ্য হবে। (সৈয়দ আলী নেওয়াজ বনাম কর্ণেল মোঃ ইউসুফ, ১৫ ডি.এল.আর. (আপিল বিভাগ) পৃষ্ঠা-৯)। কারণ তালাক সম্পূর্ন কার্যকরী না হওয়া পর্যন্ত পক্ষগন আইনসম্মতভাবে স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই থেকে যায়। (শফিকুল ইসলাম এবং অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র, ৪৬ ডি.এল.আর. পৃষ্ঠা ৭০০)। এই ৯০ দিন পর্যন্ত স্বামী তার স্ত্রী কে ভরণপোষণও দিতে বাধ্য।
নির্ধারিত নিয়ম ও সময়ান্তে প্রদত্ত একটি তালাক যদি কার্যকর হয়, তখনই কেবল তা রেজিস্ট্রি করার সুযোগ আসবে। বিদ্যমান আইনের বিধানমতে, মুসলিম বিবাহ রেজিস্ট্রি করানো বরের জন্য বাধ্যতামূলক হলেও তালাকের ক্ষেত্রে তা তালাকদাতার ইচ্ছাধীন। তবে কোনো তালাক রেজিস্ট্রি করার আগে ওই তালাকটি বিধি অনুযায়ী কার্যকর হয়েছে কি-না, সে বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা কাজির রয়েছে। কাজিরা তালাকদাতার হয়ে নোটিশ তৈরি ও পাঠানোর যে কাজটি করে থাকেন, তা শুধু তালাকের ঘোষণা হিসেবে কাজ করবে। ওই ঘোষণা শেষ পর্যন্ত কার্যকর না-ও হতে পারে। তাই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তালাক রেজিস্ট্রি করে ফেলার সুযোগ কাজির নেই। তিনি যদি সেটা করে থাকেন, তাহলে ওই রেজিস্ট্রেশন কার্যকর হওয়া কোনো তালাকের প্রমাণ হিসেবে গণ্য হবে না। কেবল মাত্র ৯০ দিন অতিবাহিত হবার পরে একজন নিকাহ রেজিস্টার কর্তৃক তালাক এর সার্টিফিকেট গ্রহণ করা যায়।
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে অধ্যাদেশের কোথাও নোটিশ প্রধান না করলে তালাক হবে না এই বিধান উল্লেখ নাই। এই বিষয়ে উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে। সিভিল রিভিশন নং ৬৯৮, ১৯৯২, মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বনাম মোছাঃ হেলেনা বেগম ও অন্যান্য।
মনে রাখতে হবে বিদেশ থেকে তালাক প্রদান করার নিয়মটা বেশ জটিল পদ্ধতি। সম্ভব হলে দেশে এসে তালাক প্রদান করাই ভাল। তবে মধ্যপ্রাচ্য ব্যাতীত বিশ্বের সকল দেশের ক্ষেত্রে আপনি এই পদ্ধতি অনুসরন করে তালাক দিতে পারবেন। আর মধ্যপ্রাচ্যে যদি আপনি অবস্থান করে থাকেন, সে ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই বাংলাদেশে এসে তালাক প্রদান করতে হবে।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮